দুর্নীতির দায় স্বীকার, গুম ও নির্বাচনের প্রশ্নে নীরব ওবায়দুল কাদের

 দুর্নীতির দায় স্বীকার, গুম ও নির্বাচনের প্রশ্নে নীরব ওবায়দুল কাদের




 বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতির কিছু অভিযোগ আংশিকভাবে স্বীকার করেছেন। তবে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বিতর্কিত নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মতো সংবেদনশীল ইস্যুগুলোতে সরাসরি জবাব দেননি।  


🔴 নির্বাচনী প্রহসন ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা:

কাদের দাবি করেছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত নির্বাচনের সময়সূচিতেই "ভোট না হওয়ার বীজ" নিহিত ছিল। তিনি বলেন, "আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হতো না। জবরদস্তি করে নির্বাচন করালে তা মুক্তিযোদ্ধাবিহীন একটি সংসদ হতো।"  


🔴 জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও সরকারের পতন: 

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। কাদের মেনে নিয়েছেন যে আওয়ামী লীগ প্রশাসন ও দলীয় পর্যায়ে এই আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি বলেন, "প্রাথমিকভাবে এটি কোটা-বিরোধী আন্দোলন মনে হলেও পরে দেখা যায়, এটি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল, কিন্তু এটি এতদূর যাবে, তা আমরা কল্পনাও করিনি।"  


তিনি আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ এড়িয়ে গিয়ে দাবি করেন, "এই আন্দোলনে জঙ্গি গোষ্ঠী জড়িত ছিল। পাকিস্তানের লস্কর-এ-তাইবার মতো সংগঠন এই অস্থিরতায় ভূমিকা রেখেছে।" তবে নিহতদের পরিবারের দাবি, পুলিশের গুলিতেই তাদের প্রিয়জনরা মারা গেছেন।  


🔴 দুর্নীতি স্বীকার, কিন্তু জবাবদিহিতার অঙ্গীকার:

ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছেন যে শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি ছিল, তবে তিনি দাবি করেন, "আমাদের সময় দুর্নীতির শাস্তি হতো। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করেছে।" অন্যদিকে, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসকে "দুর্নীতিগ্রস্ত" ও "মুক্তিযুদ্ধবিরোধী" আখ্যা দিয়ে বলেন, "গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের নামে কত মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, আত্মহত্যা করেছে, তা দেখুন।"  


🔴 গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে নীরবতা:

বিরোধী দলগুলো এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম, জোরপূর্বক গায়েব ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তুলে আসছে। ইউনূস সরকার গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করলেও ওবায়দুল কাদের এই ইস্যুতে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য দেননি। বরং তিনি ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে বলেন, "তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি টাকা থেকে সরিয়েছেন, যা তাঁর প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা দেখায়।"  


🔴আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশত্যাগ ও নেতৃত্বশূন্যতা :

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা দেশ ছেড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূল কর্মীরা এখন কারাগারে, কিন্তু নেতৃত্বের অনেকেই নিরাপদে বিদেশে। কাদের এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "অধিকাংশ নেতাই দেশে আছেন, কেউ কারাগারে, কেউ আত্মগোপনে।" তবে তিনি স্বীকার করেছেন, "বর্তমান পরিস্থিতিতে কারাবন্দি কর্মীদের সাহায্য করা কঠিন, কারণ আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের ওপর হুমকি দেওয়া হচ্ছে।"  


🔴 ইউনূস সরকারকে "অরাজকতার জন্য দায়ী":

ওবায়দুল কাদের মুহাম্মদ ইউনূসকে "ক্ষমতালোভী" ও "অস্থিতিশীলতার মূল হোতা" বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ইউনূসের আমেরিকায় দেওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, "তিনি একবার বলেছেন আন্দোলন সুনিপুণভাবে সংগঠিত, আবার পরে বলেছেন এটি স্বতঃস্ফূর্ত।"  


🔴 মূল প্রশ্ন: গুম ও নির্বাচনী প্রহসনের জবাব কবে?:

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার এই সাক্ষাৎকারে দুর্নীতির কিছু দিক স্বীকার করা হলেও গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মতো গুরুতর অভিযোগের কোনো জবাব নেই। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে—আওয়ামী লীগ কি কখনও এই অপরাধগুলোর জন্য দায় স্বীকার করবে? নাকি ইতিহাসের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করে যাবে?  


বোল্ড ট্রিবিউন প্রতিবেদন


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার সাক্ষাৎকার, আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলগুলোর বক্তব্য এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে।)

Post a Comment

Previous Post Next Post